মিরাজের রাতে নবী (ﷺ) কোনটি আগে দেখেন - সিদরাতুল মুনতাহা নাকি বাইতুল মামুর?

মিরাজের রাতে নবী (ﷺ) কোনটি আগে দেখেন - সিদরাতুল মুনতাহা নাকি বাইতুল মামুর?

44 বার দেখা হয়েছে
শেয়ার করুন:

 

পরস্পরবিরোধিতার অভিযোগঃ

নাস্তিকদের একটি ব্লগে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

 

কিছু সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মাদ() মিরাজের রাতে যাওয়ার পথে প্রথমে সিদরাতুল মুনতাহা দেখেন, এরপরে দেখেন বায়তুল মামুর বা ফেরেশতাদের ইবাদতখানা।

আবার, ভিন্ন সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, মিরাজের রাতে যাওয়ার পথে নবী মুহাম্মাদ() প্রথমে বায়তুল মামুর দেখেন, যেখানে নবী ইব্রাহীম পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। এরপরে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা দেখেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নবী মুহাম্মাদ() আগে বায়তুল মামুর দেখেন নাকি আগে সিদরাতুল মুনতাহা? কারণ দুই ধরণের বর্ণনাই পাওয়া যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছ থেকে। সমস্যা হচ্ছে, দুই ধরণের বর্ণনাই সহিহ, অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে রাবীদের স্মরণশক্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহের অবকাশ নেই!”

 

জবাবঃ

নবী () মিরাজের রাতে কোথায় সর্বশেষে গমন করেন তা আল কুরআন থেকেই স্পষ্ট। আল কুরআনে মিরাজের রাত প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে—

 

( 13 )   وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ

( 14 )   عِندَ سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ

( 15 )   عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ

অর্থঃ “আর অবশ্যই তিনি তাকে আরেকবার দেখেছিলেন। সিদরাতুল মুন্তাহা তথা প্রান্তবর্তী কুল গাছ এর কাছে। যার কাছে জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত।[1]

 

আল কুরআনে ৭ম আসমানের সিদরাতুল মুনতাহা তথা প্রান্তবর্তী কুল বরই গাছ এর উল্লেখ উল্লেখ আছে। এর পরে জান্নাত অবস্থিত। এটি সৃষ্টিজগতের প্রান্ত বা সীমা বলে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে তাফসির বাগাওয়িতে উল্লেখ আছে,

وَالسِّدْرَةُ شَجْرَةُ النَّبْقِ، وَقِيلَ لَهَا: سِدْرَةُ الْمُنْتَهَى لأنه إليها ينتهي علم الخلائق. قَالَ هِلَالُ بْنُ يَسَافَ: سَأَلَ ابْنُ عَبَّاسٍ كَعْبًا عَنْ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى وَأَنَا حَاضِرٌ، فَقَالَ كَعْبٌ: إِنَّهَا سِدْرَةٌ فِي أَصْلِ الْعَرْشِ على رؤوس حَمَلَةِ الْعَرْشِ وَإِلَيْهَا يَنْتَهِي عِلْمُ الْخَلَائِقِ، وَمَا خَلْفَهَا غَيْبٌ لَا يَعْلَمُهُ إِلَّا اللَّهُ.
অর্থঃ “আর
'সিদরাহ' হলো নবক বা কুল বরই গাছ। একে 'সিদরাতুল মুনতাহা' (শেষ সীমার কুল বরই গাছ) বলা হয় কারণ সকল সৃষ্টির জ্ঞানের সীমা সেখানে গিয়ে সমাপ্ত হয়। হিলাল ইবনে ইয়াসাফ বলেছেনঃ আমি উপস্থিত ছিলাম যখন ইবনে আব্বাস (রা.) কা'ব (র.) এর নিকট সিদরাতুল মুনতাহা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কা'ব(র.) বললেনঃ "নিশ্চয় এটি আরশের গোড়ায় অবস্থিত একটি কুল বরই গাছ, যা আরশবাহক ফেরেশতাদের মাথার উপরে। আর সকল সৃষ্টির জ্ঞান এর কাছে এসে শেষ হয়, এবং এর পেছনে যা আছে তা গায়েব, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।"[2]

 

শেষ সীমার কুল বৃক্ষ বা সিদরাতুল মুনতাহার পরের অংশে যা আছে তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। আর মিরাজের রাতে নবী () সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমন করেন, তবে এর পরে আর অতিক্রম করেননি। আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী(র.) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর(র.) একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ

 

 لَمْ يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ إِلَيْهِ.

অর্থঃ ‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ () সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ () সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন।’’ [3]

 

‘হাদীস একাডেমী’ থেকে প্রকাশিত ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’ এ এই সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছেঃ

 

সিদরাতুল মুনতাহা অর্থ শেষ সীমানার বড়ই গাছ। যেহেতু এটি একটি শেষ জায়গা এবং সেখানে এসেই থেমে যায়, যা কিছু উপর থেকে নাযিল হয় ও নিচু থেকে উপরে উঠে। তাই শেষ জায়গা হিসেবে তার অবস্থান সপ্তম আকাশে হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।[4]

 

উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহ এবং এবং তাফসির থেকে বিষয়টি স্পষ্ট, সেই সাথে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ (শেষ সীমানার কুল বরই গাছ) কথাটির অর্থ থেকেও এটি পরিষ্কার যে এটি সর্বশেষ স্থান এবং এটি সর্বশেষ এক প্রান্তে অবস্থিত। যেহেতু সিদরাতুল মুনতাহা সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থিত, এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বাইতুল মামুর আর সিদরাতুল মুনতাহার মধ্যে নবী () প্রথমে বাইতুল মামুর এবং শেষে সিদরাতুল মুনতাহায় গমন করেন। এগুলোর মধ্যে কোনটিকে তিনি আগে বা পরে দেখেন, এ প্রসঙ্গে হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমরা এখন হাদিসগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করি—

 

১ম হাদিসঃ

ثُمَّ صَعِدَ بِي إِلَى السَّمَاءِ السَّابِعَةِ، فَاسْتَفْتَحَ جِبْرِيلُ، قِيلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ‏.‏ قِيلَ وَمَنْ مَعَكَ قَالَ مُحَمَّدٌ‏.‏ قِيلَ وَقَدْ بُعِثَ إِلَيْهِ‏.‏ قَالَ نَعَمْ‏.‏ قَالَ مَرْحَبًا بِهِ، فَنِعْمَ الْمَجِيءُ جَاءَ فَلَمَّا خَلَصْتُ، فَإِذَا إِبْرَاهِيمُ قَالَ هَذَا أَبُوكَ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ‏.‏ قَالَ فَسَلَّمْتُ عَلَيْهِ، فَرَدَّ السَّلاَمَ قَالَ مَرْحَبًا بِالاِبْنِ الصَّالِحِ وَالنَّبِيِّ الصَّالِحِ‏.‏ ثُمَّ رُفِعَتْ لِي سِدْرَةُ الْمُنْتَهَى، فَإِذَا نَبِقُهَا مِثْلُ قِلاَلِ هَجَرَ، وَإِذَا وَرَقُهَا مِثْلُ آذَانِ الْفِيَلَةِ قَالَ هَذِهِ سِدْرَةُ الْمُنْتَهَى، وَإِذَا أَرْبَعَةُ أَنْهَارٍ نَهْرَانِ بَاطِنَانِ، وَنَهْرَانِ ظَاهِرَانِ‏.‏ فَقُلْتُ مَا هَذَانِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ أَمَّا الْبَاطِنَانِ، فَنَهَرَانِ فِي الْجَنَّةِ، وَأَمَّا الظَّاهِرَانِ فَالنِّيلُ وَالْفُرَاتُ‏.‏ ثُمَّ رُفِعَ لِي الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ،

অর্থঃ “… তারপর জিবরীল (আ.) আমাকে নিয়ে আমাকে নিয়ে সপ্তম আকাশের দিকে গেলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল, এ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে ডেকে পাঠান হয়েছে কি? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর প্রতি খোশ-আমদেদ। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। আমি সেখানে পৌঁছে ইব্‌রাহীম (আ.) কে দেখতে পেলাম। জিবরীল (আ.) বললেন, ইনি আপনার পিতা। তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার পুত্র ও নেক্‌কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ। তারপর আমাকে সিদ্‌রাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো হল। দেখতে পেলাম, উহার ফল হাজার অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি এই হাতির কানের মত। আমাকে বলা হল, এ হল সিদরাতুল মুন্‌তাহা (জড় জগতের শেষ প্রান্ত)। সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম, যাদের দু’টি ছিল অপ্রকাশ্য দু’টি ছিল প্রকাশ্য। তখন আমি জিবরীল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলাম, এ নহরগুলো কী? অপ্রকাশ্য দু’টি হল জান্নাতের দুইটি নহর। আর প্রকাশ্য দুটি হল নীল নদী ও ফুরাত নদী। তারপর আমার সামনে ’আল-বায়তুল মামুর’ প্রকাশ করা হল, …” [5]

 

আরো কিছু হাদিসে কিছু ভিন্ন শব্দে একই ঘটনার বিবরণ আছে। [6]

 

২য় হাদিসঃ

ثُمَّ عَرَجَ بِنَا إِلَى السَّمَاءِ السَّابِعَةِ فَاسْتَفْتَحَ جِبْرِيلُ فَقِيلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ ‏.‏ قِيلَ وَمَنْ مَعَكَ قَالَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم ‏.‏ قِيلَ وَقَدْ بُعِثَ إِلَيْهِ قَالَ قَدْ بُعِثَ إِلَيْهِ ‏.‏ فَفُتِحَ لَنَا فَإِذَا أَنَا بِإِبْرَاهِيمَ صلى الله عليه وسلم مُسْنِدًا ظَهْرَهُ إِلَى الْبَيْتِ الْمَعْمُورِ وَإِذَا هُوَ يَدْخُلُهُ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ لاَ يَعُودُونَ إِلَيْهِ ثُمَّ ذَهَبَ بِي إِلَى السِّدْرَةِ الْمُنْتَهَى

অর্থঃ “… তারপর জিবরীল (আ.) সপ্তম আসমানের দ্বারপ্রাস্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। বলা হল, কে? তিনি বললোন, জিবরীল। বলা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। বলা হল, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠান হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাঁকে ডেকে পাঠান হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হলো। সেখানে ইবরাহীম (আ.) এর সাক্ষাৎ পেলাম। তিনি বায়তুল মা’মুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। বায়তুল মামুরে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন, যারা আর সেখানে পূনরায় ফিরে আসার সুযোগ পান না। তারপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে গেলেন। …” [7]

 

৩য় হাদিসঃ

 

ثُمَّ أَتَيْنَا السَّمَاءَ السَّابِعَةَ فَمِثْلُ ذَلِكَ فَأَتَيْتُ عَلَى إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَسَلَّمْتُ عَلَيْهِ فَقَالَ مَرْحَبًا بِكَ مِنِ ابْنٍ وَنَبِيٍّ ‏.‏ ثُمَّ رُفِعَ لِيَ الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ فَسَأَلْتُ جِبْرِيلَ فَقَالَ هَذَا الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ يُصَلِّي فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ فَإِذَا خَرَجُوا مِنْهُ لَمْ يَعُودُوا فِيهِ آخِرَ مَا عَلَيْهِمْ ثُمَّ رُفِعَتْ لِي سِدْرَةُ الْمُنْتَهَى

অর্থঃ “… তারপর আমরা সপ্তম আসমানে আসলাম। এখানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন-উত্তর ও সম্বর্ধনার পর আমি ইবরাহীম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি বললেন, খোশ আমদেদ স্বাগতম (হে) পুত্র ও নবী। তারপর আমার সামনে বায়তুল মা’মূর তুলে ধরা হল। আমি জিবরীল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কোন্‌ স্থান? তিনি বললেন, এ বায়তুল মা’মূর। এখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশ্‌তা সালাত আদায় করেন। একদিনে যারা এখানে সালাত আদায় করেন, তারা এখানে কোনদিন প্রত্যাবর্তন করবেন না। এটাই তাদের শেষ (প্রবেশ)। তারপর আমার সামনে ’সিদরাতুল মুনতাহা’ তুলে ধরা হল। …” [8]

 

বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তঃ

এখানে প্রথম হাদিস থেকে স্পষ্ট যে নবী()কে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো হয়েছিল। অর্থাৎ ৭ম আসমানে, যে উচ্চতায় সিদরাতুল মুনতাহা রয়েছে, সেই উচ্চতায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি সেই অবস্থায় সিদরাতুল মুনতাহা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু সিদরাতুল মুনতাহা বৃক্ষের নিকট তাঁকে শুরুতেই নেয়া হয়নি। এরপর তিনি বাইতুল মামুর দেখতে পেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে ইমাম শিহাবুদ্দিন আল কাসতালানী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

وَمَعْنَى الرَّفْعِ تَقْرِيبُ الشَّيْءِ، وَكَأَنَّهُ أَرَادَ أَنَّ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى اسْتَبَانَتْ لَهُ بِنُعُوتِهَا كُلَّ الْاسْتِبَانَةِ، حَتَّى اطَّلَعَ عَلَيْهَا كُلَّ الِاطِّلَاعِ بِمَثَابَةِ الشَّيْءِ الْمُقَرَّبِ إِلَيْهِ.

অর্থঃ “এবং ‘উত্তোলন’ বা ‘উঠানো’ এর অর্থ হলো কোনো বস্তুকে নিকটবর্তী করা। তিনি [নবী()] বোঝাতে চেয়েছেন যে, সিদরাতুল মুনতাহা তার সমস্ত গুণাবলীসহ তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এমনকি তিনি এটিকে এমনভাবে পূর্ণরূপে অবলোকন করেছিলেন যেন এটি তাঁর নিকটবর্তী কোনো বস্তু।[9]

 

২য় হাদিসেও একই ঘটনা কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ২য় হাদিসে নবী() কর্তৃক বাইতুল মামুর দেখতে পাবার বিবরণ আগে রয়েছে। সেখানে ইব্রাহিম(আ.) পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহা বৃক্ষের অবস্থানে চলে যান। অর্থাৎ ১ম হাদিসে বাইতুল মামুর প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনার উল্লেখ আছে, সিদরাতুল মুনতাহা বৃক্ষের অবস্থানে চলে যাওয়ার বিষয়টি উহ্য আছে। ২য় হাদিসে আরো পরের কিছু ঘটনা অর্থাৎ সিদরাতুল মুনতাহার অবস্থানে যাবার উল্লেখ আছে।

 

৩য় হাদিসে একই ঘটনার ব্যাপারে আরো কিছু অতিরিক্ত তথ্য আছে। ইব্রাহিম(আ.)কে বাইতুল মামুরে দেখতে পাবার পর তিনি নবী() এর সাথে যে কথোপককথন করেন এর উল্লেখ আছে। এরপর তাঁর সামনে স্পষ্টভাবে বাইতুল মামুরকে তুলে ধরা হল। এরপর সিদরাতুল মুনতাহাকে তাঁর নিকট তুলে ধরার উল্লেখ আছে।

 

অতএব সকল হাদিসের তথ্য একত্রিত করে আমরা সম্পূর্ণ যে ঘটনা পাচ্ছি –

 

১। নবী()কে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো  -> ২। নবী মুহাম্মাদ() কর্তৃক বাইতুল মামুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসা ইব্রাহিম(আ.)কে দেখা -> ৩। নবী মুহাম্মাদ() এর সাথে নবী ইব্রাহিম(আ.) এর কথোপকথন -> ৪। বাইতুল মামুরকে নবী() এর নিকট তুলে ধরা -> ৫। নবী মুহাম্মাদ() এর সামনে সিদরাতুল মুনতাহাকে তুলে ধরা -> ৬। নবী মুহাম্মাদ() এর সিদরাতুল মুনতাহায় গমন

 

আমাদের পরিচিত পরিবেশের একটি ঘটনার উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা আরো সহজ হবে।

ধরা যাক একজন ব্যক্তি কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানটি একটি কমিউনিটি সেন্টারের ৫ তলায় হবে। তিনি লিফটে করে ৫ তলায় উঠলেন। ৫ তলায় উঠে দরজা থেকেই তিনি সেই কক্ষের সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থিত বর-কনের স্টেজ দেখতে পেলেন। তিনি সেদিকে আগাতে লাগলেন। পথিমধ্যে বরের বন্ধুর সাথে দেখা হল, যিনি একটা টেবিলের দিকে পেছন করে বসে ছিলেন। তিনি বরের বন্ধুর সাথে কিছুক্ষন কথা বললেন। কথা বলা শেষ করে সামনে এগোতেই ঐ টেবিল ভালো করে তার দৃষ্টিগোচর হল। টেবিলে কিছু মজাদার খাবার সাজানো ছিল। আরো সামনে এগোতে তার নিকট বর-কনের স্টেজ আরো ভালো করে দৃষ্টিগোচর হল। এরপর তিনি সেই স্টেজে উঠে বর-কনের সাথে ছবি তুললেন।

 

এই ঘটনাটিকে ঐ ব্যক্তি ৩ জন আলাদা ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভঙ্গীতে বর্ণনা করলেন—

 

১। বর-কনের স্টেজ কমিউনিটি সেন্টারের যেই তলায় আছে, সেই তলায় লিফটে করে উঠলাম। দরজা দিয়ে ঢুকেই স্টেজ দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছু দূর এগোনোর পরে একটা টেবিলে মজার কিছু খাবার সাজানো দেখলাম।

২। বরের বন্ধুর সাথে সাথে আমার দেখা হল। উনি একটা টেবিলের দিকে পেছন করে বসে ছিলেন। এরপরে আমি বর-কনের স্টেজে গিয়েছিলাম। 

৩। সেদিন বরের বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিল। এরপরে একটা টেবিলে মজার কিছু খাবার সাজানো দেখলাম। এরপর বর-কনেকে স্টেজের একদম সামনে থেকে দেখলাম।

 

এখানে একই ঘটনাকে ভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। একেক সময়ে একেক দিককে প্রাধান্য দিয়ে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই বর্ণনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে কেউ এর মাঝে কোনো বৈপরিত্য পাবে না।

 

একইভাবে মিরাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিসেও একই ঘটনার বিভিন্ন অংশ বর্ণিত হয়েছে। কাজেই হাদিসগুলোতে কোনো পরস্পরবিরোধিতা বা বৈপরিত্য নেই।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] আল কুরআন, নাজম ৫৩ : ১৩-১৫

[2] তাফসিরুল বাগাওয়ি (ইহইয়াউত তুরাছ) – আবু মুহাম্মাদ আল বাগাওয়ি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩০৬, সুরা নাজমের ১৪ নং আয়াতের তাফসির

https://shamela.ws/book/12217/2234

অথবা https://archive.is/wip/lW0HM (আর্কাইভকৃত)

[3] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩।

সূত্রঃ আল ফিকহুল আকবর (বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা) -  ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর , পৃষ্ঠা ৪৯৭-৪৯৮

এবং, হাদীসের নামে জালিয়াতি - ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=4815

[4] মিশকাতুল মাসাবীহ (হাদীস একাডেমী), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৫৮৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=85841

[5] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩৬০৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3866

[6] দেখুনঃ

সহীহ ইবনু হিব্বান, হাদিস নং : ৪৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=86946

মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং : ৫৮৬২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=85838

[7] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৩০৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=8099

[8] সুনান নাসায়ী, হাদিস নং : ৪৪৯ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=9559

আরো দেখুনঃ সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৯৮০

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3110

[9] ইরশাদুস সারি লি শারহি সহিহিল বুখারী - শিহাবুদ্দীন আল ক্বাসতালানী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩২৬

https://shamela.ws/book/21715/3629

অথবা https://archive.is/wip/UTjqF (আর্কাইভকৃত)

 

সোশ্যাল লিঙ্ক ও অ্যাপ

সর্বাধিক পঠিত

সর্বশেষ পোস্টসমূহ